অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চার মাস অতিবাহিত হলেও পুলিশ প্রশাসনে সক্রিয় রয়েছে ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীলীগ সিন্ডিকেট। পুলিশ সদর দফতরসহ আটটি ইউনিটে কর্মরত এসব সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা সরকারের গোপন তথ্য পলাতক খুনি আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মকর্তাদের কাছে পাচার করছেন।
সূত্র জানায়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সমর্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের এ ধরনের কার্যক্রমের কারণেই গত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের বিদেশে পালাতে সহায়তা করার অভিযোগও রয়েছে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা যারা সরাসরি গনহত্যার সাথে জড়িত ছিল বলে আত্মগোপনে গেলেও তাদের বিশ্বস্তরা এখনও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। এরা কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোপন তথ্য পাচার করে যাচ্ছেন। এর ফলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সিন্ডিকেটের কার্যক্রম শুধুমাত্র প্রশাসনের চেইন অব কমান্ডকেই বিপন্ন করছে না, বরং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যে বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল, তার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইমেজ দেশে-বিদেশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের গুলিতে শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজন, পুলিশ, আনসারসহ দুই হাজারের মতো প্রাণ হারিয়েছেন। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক রক্তাক্ত ও আহত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা এই প্রথম। ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে চলে যান ভারতে। আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের বড় বড় নেতা চলে যান আত্মগোপনে। তাদের মতোই ছাত্র-জনতার হত্যার সাথে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত আত্মগোপনে থাকেন। পুলিশের খাতায় ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তাছাড়া প্রায় ২৫ জনের মতো গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের রিমান্ডে নিয়ে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের বেপরোয়া বলপ্রয়োগ পুরো পুলিশ বাহিনীকে দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার তদন্ত করে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পুলিশে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরে থাকা অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দফতর থেকে এখনও পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (এসবি) এবং ডিএমপিতেও এই সিন্ডিকেটের শক্ত অবস্থান রয়েছে। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনারসহ একাধিক ডিসি ও এডিসি আওয়ামী সিন্ডিকেটের অংশ হিসেবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নৌপুলিশ, সিআইডি, হাইওয়ে পুলিশ, এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটেও এই সিন্ডিকেট সক্রিয়।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনারসহ বেশ কয়েকজন ডিসি ও এডিসি রয়েছেন যারা আওয়ামী সিন্ডিকেটের পুলিশ কর্মকর্তারা। পলাতক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের সময় এদের ডিএমপিতে পদায়ন করা হলেও বর্তমান সরকারের সাড়ে চার মাস গেলেও এদের সরানো হয়নি। ফলে এরা ডিএমপি বর্তমান প্রশাসনের আস্থাভাজন হয়ে তথ্য ফাঁস করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট সারদা পুলিশ একাডেমি। যেখানে বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাসহ নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এসআইদের দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন যারা সাবেক আইজিপি বেনজীর ও মনিরুল-হাবিব সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন। যা ওপেন সিক্রেট। তারাও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এছাড়া নৌপুলিশ, সিআইডি, হাইওয়ে পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, এটিইউ ও পিবিআইয়ের মত পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে বহাল থেকে নানা কায়দায় তথ্য ফাঁস করছেন বেনজীর ও মনিরুল-হাবিব সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্যরা।
সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, সিআইডিতে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর মামলা রয়েছে। এছাড়া বিদেশে টাকা ও মানব পাচার, সোনা ও মাদক চোরাচালানসহ অতিগুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করা হয়। মোবাইল মনিটরিং ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট রয়েছে সিআইডিতে। একই সাথে ব্যাংকের জালিয়াতিসহ বৈদেশিক জালিয়াতি নিয়েও কাজ করে সংস্থাটি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় পতিত সরকারের সময় খুন-গুমের সাথে জড়িত কর্মকর্তারাও বহাল তবিয়তে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। যা ওপেন সিক্রেট হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেখবর।