পাঠ্যবই মুদ্রণ কেলেঙ্কারি: ৫০টি ছাপাখানার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত, আলোচনায় মোস্তাফা জব্বারের ভাই
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাকে ঘিরে গোপন ষড়যন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের অভিযোগে অবশেষে আইনি তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্প্রতি এনসিটিবির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এক অফিসিয়াল চিঠিতে প্রায় ৫০টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ও নথিপত্র চাওয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হলো সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই রাব্বানী জব্বারের মালিকানাধীন আনন্দ প্রিন্টার্স লিমিটেড। তিনি বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতিও।
সূত্র জানায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর কার্যাদেশ, চুক্তিপত্র, বই গ্রহণ-সম্পর্কিত রিসিভিং কমিটির প্রতিবেদন, ছাপার মান নিরীক্ষণ, বিল পরিশোধের সময়সূচি, পোর্ট ড্যামেজ সংক্রান্ত সুবিধা এবং নিম্নমানের বই সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা—এই সব বিষয়ে দুদক তথ্য চেয়েছে।
দুদকের চিঠিতে আরও বলা হয়, ছাপার কাজে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কারা আমদানিকৃত কাগজে পোর্ট ড্যামেজ সুবিধা পেয়েছে, সে বিষয়ে ইনভয়েস, এলসি নম্বর, টাকার পরিমাণসহ বিস্তারিত তথ্যও দিতে হবে। পাশাপাশি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে নিম্নমানের বই সরবরাহকারীদের তালিকা, ঠিকানা, তদন্ত প্রতিবেদন এবং তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
চিঠি পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী জানান, “আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠিটি পেয়েছি। যেহেতু এটি অফিসিয়াল চিঠি, আমরা তথ্য সরবরাহ করব।”
এনসিটিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে পাঠ্যবই ছাপার নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাট হয়েছে। তদন্ত হলে অনেক অজানা তথ্য বের হয়ে আসবে।”
জানা গেছে, এনসিটিবির অধীন ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপাকে ঘিরে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। গত ২১ জুন ঢাকা ক্লাবে একটি গোপন বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে ১১৬টি ছাপাখানার মালিককে আমন্ত্রণ জানানো হয় এসএমএসের মাধ্যমে। বৈঠকে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক বিতর্কিত নেতার অংশগ্রহণের সম্ভাবনা ছিল। তবে গোয়েন্দা তৎপরতায় শেষ মুহূর্তে তা পণ্ড হয়ে যায়।
এখন পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠান দুদকের নজরে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে: আমিন আর্ট প্রেস, আনন্দ প্রিন্টার্স, বলাকা প্রিন্টার্স, অনুপম প্রিন্টার্স, মোল্লা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রিন্টিং, ফাহিম প্রিন্টিং, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স, কাশেম অ্যান্ড রহমান, আলিফ প্রিন্টিং, মেরাজ প্রিন্টিং, মৌসুমী অফসেট, জনতা প্রেস, রেদওয়ানিয়া প্রেস, টাঙ্গাইল অফসেট, ভয়েজার পাবলিকেশন্স, রূপালী প্রিন্টিংসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান।
বিশ্লেষকদের মতে, এই তদন্তে যদি স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয় এবং প্রভাবমুক্তভাবে প্রমাণ সংগ্রহ হয়, তবে এটি হতে পারে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় দুর্নীতির দায়মুক্তি ভাঙার ঘটনা। পাঠ্যবই ছাপার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দুর্নীতির বিচার হলে জনগণের আস্থা বাড়বে এবং ভবিষ্যতে শিক্ষা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে।