অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছেন যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করবে কিনা, তা দলটির নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। এছাড়া, নির্বাচনে কারা অংশ নেবে, তা নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস জানান, সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত বছর ক্ষমতা থেকে অপসারণের পর নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব পেয়ে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, "আমার কোনো ধারণা ছিল না যে আমি সরকারের নেতৃত্ব দেব। আমি এর আগে কখনো সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করিনি, তারপরও পরিস্থিতি বুঝে সঠিকভাবে কাজ করতে হয়েছিল।" তিনি আরও বলেন, "প্রথমে স্থির হওয়ার পর আমরা অন্যান্য বিষয় সংগঠিত করতে শুরু করি, যার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অর্থনীতি ঠিক করা দেশের জন্য অগ্রাধিকার ছিল।"
গত বছরের আগস্টের শুরুতে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন এবং এখনও সেখানে নির্বাসনে রয়েছেন। এই পটপরিবর্তনের পর সাবেক সরকারের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা চিত্র প্রকাশ্যে আসে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিও উঠেছে।
ড. ইউনূস আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই বছরের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে। তবে, ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনা এবং তার দল সেই নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে বিচারের জন্য দেশে ফেরানোর প্রচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, "তাদের অর্থাত আওয়ামী লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, আমি তাদের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করবে, তা নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়।"
নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, "যদি আমাদের ইচ্ছামতো দ্রুত সংস্কার করা যায়, তাহলে ডিসেম্বরে আমরা নির্বাচন করতে পারব। আর যদি সংস্কারের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।" তিনি আরও উল্লেখ করেন, "শান্তি ও শৃঙ্খলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এরপর অর্থনীতি। এটি এক বিধ্বস্ত অর্থনীতি, যেন ১৬ বছর ধরে কোনো ভয়ানক টর্নেডো হয়েছে এবং আমরা এখন টুকরোগুলো তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছি।"
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, "বেটার একটি আপেক্ষিক শব্দ। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি গত বছরের একই সময়ের সাথে তুলনা করেন, তবে এটি অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা ঠিক আছে। এখন যা ঘটছে, তা অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা বা ভিন্ন কিছু নয়।" তিনি দেশের বর্তমান দুর্দশার জন্য আগের সরকারকে দায়ী করেন এবং বলেন, "এই ধরনের ঘটনাগুলো হওয়া উচিত— তা আমি সমর্থন করছি না। আমি বলছি যে, আপনাকে বিবেচনা করতে হবে, আমরা কোনো আদর্শ দেশ বা আদর্শ শহর নই যা আমরা হঠাৎ করে তৈরি করেছি। এই অবস্থা হচ্ছে দেশের ধারাবাহিকতা যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, এমন একটি দেশ যেখানে এসব বহু, বহু বছর ধরে চলছে।"
শেখ হাসিনার নৃশংস শাসনের শিকার মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ। ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর মারাত্মক দমন-পীড়নের জন্য তার বিচারের দাবিতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমেছে। বাংলাদেশের একটি আদালত হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে, কিন্তু তাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে ভারত এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এদিকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হাসিনা ইউটিউবে ভাষণ দেবেন এমন খবরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে হাসিনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের সদস্যদের বেশ কয়েকটি বাড়ি ভাংচুর এবং আগুন দেওয়া হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তী সরকারকে সহিংসতার ন্যায্যতা দেওয়ার অভিযোগ করেছে। বাংলাদেশ তাদের জন্য নিরাপদ নয় বলে আওয়ামী লীগের সদস্যদের দাবি সম্পর্কে বিবিসি জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, "দেশে আদালত আছে, আইন আছে, থানা আছে, তারা গিয়ে অভিযোগ করতে পারে, তাদের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারে। আপনারা অভিযোগ করতে কেবল বিবিসি সংবাদদাতার কাছে না গিয়ে অভিযোগ করতে থানায় যান এবং দেখুন আইন তার গতিতে কাজ করছে কিনা।"
ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশি সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত এবং কার্যকরভাবে মার্কিন এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নকৃত প্রায় সব কর্মসূচি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মতো দেশে প্রভাব ফেলবে, এই প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, এটা তাদের সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, "এটি ভালোই হয়েছে। কারণ তারা এমন কিছু করছে যা আমরাই করতে চেয়েছিলাম, যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং এর মতো আরও জিনিস, যা আমরা কখনোই ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারিনি।" যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারি উন্নয়ন সহায়তার তৃতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিভাবে এই ঘাটতি পূরণ করা হবে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, "যখন এটা হবে, আমরা তা পূরণ করব।"