দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন শুল্ক নীতি ঘোষণা করেছেন, যা ভারতের জন্য বড় ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন ‘পারস্পরিক শুল্ক’ (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) নীতির আওতায় কোনো নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্যবস্তু না করে, বরং সকল দেশের ওপর সমান মাত্রার শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভারতের বার্ষিক রফতানি খাতে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সিটি রিসার্চ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন শুল্ক নীতির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের গাড়ি নির্মাণ খাত এবং কৃষি রফতানি। এছাড়া, রাসায়নিক, সঙ্কর ধাতু, অলঙ্কার, ওষুধ এবং খাদ্যপণ্যও বড় ধরনের শুল্কের আওতায় পড়বে। সরকারি তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ৭,৪০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে মুক্তা ও অন্যান্য রত্নের পরিমাণ ছিল ৮৫০ কোটি ডলার, ওষুধ ৮০০ কোটি ডলার এবং পেট্রোপণ্য ৪০০ কোটি ডলার।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির অন্যতম কারণ হল, ভারতীয় পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্কের তুলনায় আমেরিকান পণ্যের ওপর নয়াদিল্লির শুল্ক অনেক বেশি। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ভারত গড়ে ১১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যা মার্কিন শুল্কের তুলনায় প্রায় ৮.২ শতাংশ বেশি। বিশেষ করে, খাদ্যদ্রব্যের ওপর ভারতের শুল্ক হার ৬৮ শতাংশ, জুতো ও পরিবহন সরঞ্জামের ওপর ১৫-২০ শতাংশ এবং কারুশিল্প ও যন্ত্রপাতির ওপর সাত শতাংশ।
এই উচ্চ শুল্কের কারণে অতীতে ভারত লাভবান হলেও, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নীতির কারণে এবার সেই সুবিধা আর পাবে না নয়াদিল্লি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারস্পরিক শুল্ক আরোপ হলে ভারতীয় কৃষিপণ্য রফতানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের কৃষিপণ্যের শেয়ার তুলনামূলকভাবে কম।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-মার্কিন বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ওষুধ, রত্ন ও অলঙ্কার খাত। তবে তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিতে রয়েছে কাপড়, চামড়া ও কারুশিল্পজাত পণ্য, কারণ এসব পণ্য অনেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ এশিয়ায় উৎপাদন করে থাকে।
বিশ্বব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যদি ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তাহলে ভারতের অর্থনীতিতে ৫০ থেকে ৬০ বেসিস পয়েন্ট ক্ষতি হবে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের আমদানি ১১-১২ শতাংশ কমে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন কিছু পণ্যের শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দামি মোটরবাইকের শুল্ক ৫০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে, এবং বোরবন হুইস্কির শুল্ক ১৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০০ শতাংশ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-মার্কিন সম্পর্কের এই উত্তেজনা কমাতে নয়াদিল্লি হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি বাড়ানোর পথে হাঁটতে পারে।
উল্লেখ্য, ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে ইতোমধ্যে কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক, চীনের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক এবং ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনও আমেরিকান পণ্যের ওপর ১০-১৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে।
গত ১৩-১৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে এর আগেই ট্রাম্প পারস্পরিক শুল্ক নীতির ঘোষণা দেন, যেখানে যেকোনো দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করবে, আমেরিকাও সেই একই পরিমাণ শুল্ক বসাবে। ট্রাম্পের দাবি, এতে বাণিজ্যে ন্যায্যতা আসবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নীতি কার্যকর হলে ভারতের বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।