জেলেনস্কিকে অকৃতজ্ঞ বললেন ট্রাম্প, রাশিয়ার জয়যাত্রা অব্যাহত
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মোড় ক্রমশ রাশিয়ার দিকে ঘুরছে। সামরিক ময়দানে একের পর এক এলাকা দখলে নিচ্ছে মস্কো, বিপরীতে ইউক্রেন কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবার যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ বলে দাবি করলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, রাশিয়ার অব্যাহত অগ্রগতি, ইউরোপীয় মিত্রদের চাপ—সব মিলিয়ে চরম সংকটের মুখে পড়েছেন কিয়েভের নেতৃত্ব।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলে নতুন করে এলাকা দখল করেছে। সীমান্তবর্তী ছোট্ট গ্রাম নোভেনসহ কুরস্ক অঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায় তাদের ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত’ হয়েছে। এর ফলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ইউক্রেনীয় সরবরাহ পথ হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক দিক থেকে এটি রাশিয়ার জন্য একটি বড় অগ্রগতি, যা ইউক্রেনকে আরও দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে।
অন্যদিকে কূটনৈতিকভাবে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে জেলেনস্কি এবার আলোচনার পথে হাঁটতে চান। তিনি সৌদি আরবে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘গঠনমূলক সংলাপ’ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছেন। ওয়াশিংটনও এই আলোচনার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে, তবে শর্ত সাপেক্ষে। জেদ্দায় আসন্ন বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধবিরতির একটি কাঠামো তৈরি করতে চাইছে।
তবে জেলেনস্কি-ট্রাম্প সম্পর্ক এখন চরম সংকটপূর্ণ। গত মাসে ওভাল অফিসে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। এর পাশাপাশি দেশটির জন্য বরাদ্দ করা সাহায্যও স্থগিত রাখা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে, জেলেনস্কিকে আলোচনার টেবিলে আনতে চাপ প্রয়োগ করাই সঠিক কৌশল।
এদিকে ট্রাম্প বরাবরই দাবি করে আসছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে এই যুদ্ধ কখনই শুরু হতো না। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি আবারও জেলেনস্কির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘‘তিনি খুব সহজেই এই দেশ থেকে টাকা নিয়ে গেছেন, আমি মনে করি না তিনি কৃতজ্ঞ।’’ ট্রাম্প আরও বলেন, ‘‘আমরা ইউক্রেনকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছি, অথচ তিনি সবসময় বলছেন, তাদের আরও দরকার।’’
ইউরোপীয় দেশগুলো ইতোমধ্যে তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ তারা ইউক্রেনকে সমর্থন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু ওয়াশিংটনের অবস্থান এখন কঠোর। ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের ন্যাটো উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিকেও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা কমিয়ে ইউরোপকে আরও বেশি দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
এদিকে জেলেনস্কি সৌদি আরব সফরের ঘোষণা দিয়ে সংকট উত্তরণে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন। তিনি জানিয়েছেন, রিয়াদ সফরের পরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘‘এই যুদ্ধের শুরু থেকেই আমরা শান্তির চেষ্টা করে আসছি। দ্রুত এবং কার্যকরভাবে এগোনোর জন্য আমাদের বাস্তবসম্মত প্রস্তাব টেবিলে আছে।’’
কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তবতা ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাশিয়ার দখলদারিত্বের মধ্যেই জেলেনস্কি রবিবার রাতে এক ভাষণে বলেন, ‘‘আমি আমাদের সকল ইউনিটকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা দখলদারদের ধ্বংস করতে, আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং আমাদের অবস্থান রক্ষা করতে নিরলস কাজ করছে।’’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউক্রেন এখন সামরিক ও কূটনৈতিক উভয়ভাবেই কঠিন এক চাপে রয়েছে। রাশিয়া একের পর এক এলাকা দখল করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করছে, যুক্তরাষ্ট্র আবার কিয়েভকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে চায়। তার ওপর ইউরোপীয় মিত্ররাও ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান বদলাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে জেলেনস্কির সামনে দুটি পথ খোলা আছে—এক, সামরিকভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়া, যা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে; দুই, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা, যেখানে তার হাতে খুব বেশি কার্ড নেই। তিনি যেকোনো পথই বেছে নেন না কেন, রাশিয়ার জয়যাত্রা যে থামছে না, সেটি স্পষ্ট।