বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। চলতি বছরের অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই গণ-অভ্যুত্থানের 'ঘোষণাপত্র' তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপ সব রাজনৈতিক দলই সমর্থন করছে, তবে এটি বাস্তবায়ন কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল, বর্তমানে কিছুটা থেমেছে এবং তা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্কও আপাতত পরিহার করা গেছে। তবে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রটি কীভাবে তৈরি হবে এবং এতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ছাত্রনেতারা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছেন, ঘোষণাপত্রে ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিলের কথা বলা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করার দাবিও উঠেছে। তবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা চান যে, এই ঘোষণাপত্রে শুধু জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের অভ্যুত্থান নয়, বরং গত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অন্তর্ভুক্ত করা হোক। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, তারা মনে করেন, ঘোষণাপত্রে গুম, খুন, নির্যাতন ও নিপীড়নের কথা উল্লেখ করা উচিত এবং এটি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে, বিএনপি গণ-অভ্যুত্থানকে বিপ্লবের পরিবর্তে 'গণ-অভ্যুত্থান' বলে মনে করছে এবং তারা বিশ্বাস করে, ঘোষণাপত্র নয়, বরং একটি ‘ডিক্লারেশন’ বা ‘ঘোষণা’ আসা উচিত। বিএনপির মতে, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল এবং তার পরবর্তী সময়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছিল, যা সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। তাদের মতে, এখন কোনো ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করা সঠিক হবে না।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী দলও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। তাদের নেতারা ছাত্রদের উদ্যোগকে ‘স্বাধীন মতপ্রকাশের’ জায়গা থেকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে সরকার এবং ছাত্রদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো স্পষ্টতা না থাকায় তারা মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে ঘোষণাপত্র তৈরি হবে, তার ব্যাপারে এখনও কোনো অফিসিয়াল ঘোষণা হয়নি, তাই তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করবেন না।
এছাড়া, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন, সরকারের এখন নতুন উদ্যোগ নেওয়ার কোনো বাস্তবতা নেই। তিনি মনে করেন, সরকারকে আর কালক্ষেপণ না করে নির্বাচন নিয়ে দ্রুত একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির বিষয়ে যদিও বিতর্ক চলছে, তবে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মনে করছে, এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এর প্রক্রিয়াকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত হবে না। নেতারা মনে করছেন, ছাত্রদের এই উদ্যোগ আসলে ঐক্যের একটি উদাহরণ এবং এটি দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘোষণাপত্র তৈরির প্রক্রিয়া যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে এটি রাজনৈতিক বিভক্তি এবং সংকটের কারণ হতে পারে। এর মধ্যে যে প্রশ্নগুলো ওঠেছে, তা হলো—সংবিধান বাতিল এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণ-অভ্যুত্থানকে একত্রিত করার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?