জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত সুপারিশ করা হয়েছে। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পাঁচটি খাতে সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে। এই খাতগুলো হল: জবাবদিহি ও বিচারব্যবস্থা, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী, নাগরিক পরিসর, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, এবং অর্থনৈতিক সুশাসন।
প্রথমত, বিচারব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের সুপারিশ অনুযায়ী, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য কার্যকর, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে। অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং তাদের নির্দেশের নথি সংরক্ষণের পাশাপাশি এমন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করা হবে, যারা প্রমাণ নষ্ট বা লুকানোর চেষ্টা করবেন। বিচারব্যবস্থার সব স্তরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে একটি ক্রান্তিকালীন মডেল তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী-এর সংস্কারে জাতিসংঘ বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পুলিশ বাহিনীর প্রবিধান সংশোধন করে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী পুলিশকে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষত, ধাতব (প্রাণঘাতী) গুলি ব্যবহার বন্ধ করার এবং পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে।
নাগরিক পরিসর বিষয়েও জাতিসংঘ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সাইবার নিরাপত্তা আইন, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন, সন্ত্রাসবাদ দমন আইন, এবং মানহানি আইন সংশোধন করে নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিরোধীদের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা-এ জাতিসংঘ জানিয়েছে, অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনে সব দলের সমান সুযোগ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে, কারণ এর ফলে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করা অর্থ এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং দুর্নীতি দমন আইনের সঠিক প্রয়োগে সুপারিশ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের এসব সুপারিশের লক্ষ্য বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়ন এবং একটি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা।