চোখের জলে লেখা ইতিহাস: হিরোশিমার একটি দিনের গল্প
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। জাপানের হিরোশিমা শহরটি ছিল এক ব্যস্ত নগরী, যেখানে মানুষের দৈনন্দিন জীবন চলছিল সাধারণ গতিতে। কিন্তু মাত্র একটি মুহূর্তে সবকিছু বদলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে ফেলা হয় “লিটল বয়” নামে একটি পারমাণবিক বোমা। সেই একটি বিস্ফোরণ মুহূর্তেই হাজারো জীবন শেষ করে দেয়, শহরটিকে পরিণত করে ধ্বংসস্তূপে।
হিরোশিমার পারমাণবিক হামলা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এবং অন্যতম বিধ্বংসী যুদ্ধকালীন ঘটনা। বোমাটি বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই ৭০,০০০-এরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়, আর তীব্র তাপ এবং শকওয়েভে ধ্বংস হয়ে যায় শহরের ৮০ শতাংশ। তবে এই সংখ্যা কেবল সেই দিনের হিসাব। পরবর্তী কয়েক বছরে রেডিয়েশনের প্রভাবে অসংখ্য মানুষ ক্যানসার, লিউকেমিয়া এবং অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে শহরের কিছু অংশে মানুষ এবং স্থাপনাগুলোর ছায়া পুড়ে মাটিতে মিশে যায়। একটি গাছ, একটি দেওয়াল কিংবা একটি সিঁড়ির ধাপে সেই ছায়াগুলো ছিল তখনকার ভয়াবহতার নীরব সাক্ষী। বেঁচে থাকা মানুষরা সহ্য করেছিল দগ্ধ ত্বক, তৃষ্ণার্ত দেহ, এবং হারানো আপনজনের শোক। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, “আমার চারপাশে শুধু ধ্বংস আর কাতরানো মানুষের আর্তনাদ। কেউ পানি খুঁজছে, কেউ পরিবারের মানুষদের ডাকছে, আর কেউ মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।”
হিরোশিমার এই মর্মান্তিক ঘটনার পরেও বেঁচে থাকা মানুষগুলো তাদের জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিল। ধ্বংসস্তূপ থেকে শহরটি ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত হয়। বর্তমানে হিরোশিমা শুধু এক ইতিহাসের অংশ নয়, এটি শান্তি এবং মানবতার প্রতীক। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে শান্তি মেমোরিয়াল পার্ক, যেখানে প্রতি বছর লাখো মানুষ আসে পারমাণবিক যুদ্ধের ক্ষত ও তার শিক্ষা সম্পর্কে জানার জন্য।
আজ, হিরোশিমার গল্প শুধুমাত্র একটি যুদ্ধের করুণ কাহিনী নয়; এটি এক সতর্কবার্তা, যা বলে দেয় পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার কতটা বিধ্বংসী হতে পারে। এটি মানবতার এক শপথের গল্প, যা বলে যে আমরা কখনও আর সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই না। হিরোশিমা তাই আজও কাঁদে, কিন্তু তার কান্নায় মিশে থাকে এক নতুন ভোরের প্রতিজ্ঞা।