১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল, পৃথিবী সাক্ষী হয়েছিল মানবসৃষ্ট সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনার—চেরনোবিল বিপর্যয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান ইউক্রেন) চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ রিয়্যাক্টরে ঘটে এই বিস্ফোরণ, যা এক মুহূর্তে লাখ লাখ মানুষের জীবনকে পাল্টে দেয়। বিজ্ঞানীরা একে আধুনিক সভ্যতার অন্যতম ভয়ংকর দুর্যোগ হিসেবে উল্লেখ করেন, যার প্রভাব আজও রয়ে গেছে।
ঘটনার দিন রিয়্যাক্টরের ভেতরে একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অত্যাধিক তাপে রিয়্যাক্টরের কোর গলে গিয়ে এক বিশাল বিস্ফোরণের সৃষ্টি করে। এতে তেজস্ক্রিয় কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউক্রেনসহ আশপাশের দেশগুলোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিস্ফোরণের ফলে নির্গত বিকিরণের মাত্রা ছিল হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলা পারমাণবিক বোমার বিকিরণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
দুর্ঘটনার পরপরই আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে এত বড় বিপর্যয়ের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, সোভিয়েত সরকার শুরুতে এই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো যখন তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়তে দেখল, তখন বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। চেরনোবিলের প্রভাব এতটাই মারাত্মক ছিল যে, আশপাশের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা সম্পূর্ণ জনশূন্য ঘোষণা করা হয় এবং আজও সেই অঞ্চলকে 'এক্সক্লুশন জোন' হিসেবে গণ্য করা হয়।
তেজস্ক্রিয়ার প্রভাব কয়েক দশক পরেও লক্ষ করা যায়। হাজার হাজার মানুষ ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্ম নেয় জিনগত ত্রুটি নিয়ে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এই তেজস্ক্রিয় অঞ্চলে আজও কিছু মানুষ বসবাস করছে, যদিও এটি বিজ্ঞানীদের জন্য এক গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে, চেরনোবিল ধ্বংসাবশেষ শুধু বিপর্যয়ের স্মৃতিচিহ্ন নয়, এটি পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে এই পরিত্যক্ত শহর, বিশেষ করে প্রিপিয়াত ঘুরে দেখতে। ভুতুড়ে এই নগরীতে পরিত্যক্ত বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল আর পার্ক দেখে মনে হয়, জীবন যেন হঠাৎ থেমে গেছে।
চেরনোবিল বিপর্যয় বিশ্বকে শিখিয়েছে পারমাণবিক শক্তির বিপদ এবং এর যথাযথ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা। এই ঘটনাটি আজও বিজ্ঞানীদের মনে করিয়ে দেয়, ভুল সিদ্ধান্তের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।