গাজায় মানবিক বিপর্যয়: বন্ধ ত্রাণ, জোরদার ইসরায়েলি হামলায় শিশুসহ আরও ৮ মৃত্যু
গাজার মানবিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর থেকেই গাজায় সব ধরনের ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। রমজানের শুরুতেই ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে, আর জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, যদি দ্রুত ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া হয়, তাহলে গাজার লাখো মানুষের জন্য অনাহার অনিবার্য হয়ে উঠবে। এমন অবস্থার মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা আরও জোরদার হয়েছে, যেখানে শিশুসহ বহু নিরীহ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-এর প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি সরাসরি ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, গাজায় ‘অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে’ ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি জানান, ইসরায়েল কেবল খাদ্য সহায়তাই বন্ধ করেনি, বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, যার ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট আরও তীব্র হয়েছে। তার মতে, এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘের সকল নিয়মের বিরোধী। লাজ্জারিনি আরও বলেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের আলোচনার পর গাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে উল্টোটি ঘটেছে।
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানালেও ইসরায়েল তাদের নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি ইউএনআরডব্লিউএ-তে অর্থায়নও স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা এই সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত আমেরিকাই ছিল ইউএনআরডব্লিউএ-এর সবচেয়ে বড় দাতা। কিন্তু ইসরায়েলের অভিযোগের পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সংস্থাটির জন্য বরাদ্দ অর্থ কমিয়ে দেন। আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইউএসএআইডি-র অর্থায়নও বন্ধ করেছেন, যা গাজায় খাদ্য সরবরাহের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল।
এই সংকটের মধ্যেই ইসরায়েল গাজায় হামলা আরও বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে তারা প্রতিদিনই নতুন নতুন স্থানে বিমান ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। সম্প্রতি গাজার নেটজারিম এলাকায় একদল ফিলিস্তিনি ধ্বংসস্তূপের কাছে জড়ো হলে তাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালানো হয়, যেখানে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। একইভাবে রাফাহ শহরের পূর্বে একটি গ্রামে আরেকটি হামলায় একজন ফিলিস্তিনি নারী নিহত হন।
গাজার খান ইউনিসেও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা অব্যাহত রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেখানে ঘরবাড়িতে সরাসরি গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ অঞ্চলে এক শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, ওই শিশু প্রথমে গুরুতর আহত হয়, পরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যায়।
যদিও যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুযায়ী গাজায় স্থায়ী শান্তি ও বন্দি বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে, তবে বাস্তবে ইসরায়েলের নৃশংস আক্রমণ থামার কোনো লক্ষণ নেই। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ইতোমধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে, কিন্তু তাতেও দেশটি থামেনি।
এদিকে, মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফ ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা কাতারে নতুন দফার আলোচনা শুরু করেছেন, যেখানে হামাসও যুক্ত হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি ছাড়া যে কোনো আলোচনা অর্থহীন।
জাতিসংঘের মতে, গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার ফলে প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে, যার ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ড বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ইসরায়েলের বর্বরতায় বিশ্বব্যাপী সমালোচনা বাড়লেও পশ্চিমা শক্তিগুলোর নীরবতায় এখনো তাদের হামলা অব্যাহত রয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, যদি দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া হয় এবং ইসরায়েল তার আগ্রাসন বন্ধ না করে, তবে গাজায় মানবিক বিপর্যয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা, অন্যদিকে খাদ্য ও ওষুধের অভাবে লাখো মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়েছে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, নাকি তারা নিষ্ক্রিয় থেকেই মানবিক এই বিপর্যয়ের আরও তীব্র হওয়ার অপেক্ষা করবে।