দীর্ঘ ১৫ মাসের নজিরবিহীন সামরিক আগ্রাসন, হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ আর অবরোধের পর কিছুদিনের জন্য শান্তির আশা দেখা দিয়েছিল ফিলিস্তিনের গাজায়। কিন্তু সেই আশা আরেকবার গুঁড়িয়ে দিতে নতুন ষড়যন্ত্রে মেতেছে দখলদার ইসরাইল। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা যখন সামান্য স্বস্তির খোঁজে, তখনই নতুন করে মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে নেতানিয়াহুর সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি আসলে ফিলিস্তিনিদের ‘দ্বিতীয় নাকবা’র দিকে ঠেলে দেওয়ারই ইঙ্গিত।
ইতিহাসের পাতায় নাকবা শব্দটি চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তত সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেই নির্মম ট্র্যাজেডি আজও ভুলতে পারেননি ফিলিস্তিনিরা। এবারও যেন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে দখলদাররা। কয়েক সপ্তাহ আগেই গাজায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ঘরবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছিল লাখ লাখ মানুষ, কিন্তু ইসরাইলি ড্রোন থেকে প্রচার করা হয়েছে হুমকি—“দ্বিতীয় ও তৃতীয় নাকবা আসছে, কেউ বাঁচতে পারবে না!”
গাজার ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই ১৯৪৮ সালের নাকবার শিকার হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধর। তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি আজকের ইসরাইল, আর তারা নিজ দেশে হয় শরণার্থী, নয়তো অবরুদ্ধ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইলের অব্যাহত সামরিক অভিযানে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হন। যুদ্ধবিরতির সুযোগে ঘরে ফেরা মানুষগুলো নতুন করে স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু ইসরাইল তা চোখের সামনেই ভেঙে দিচ্ছে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, হামাস যদি যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে রাজি না হয়, তাহলে গাজায় কোনো ধরনের পণ্য প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এই ঘোষণার পর থেকেই গাজায় এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রমজানের শুরুতেই খাবার, পানি, ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষ ইফতার বা সেহরির জন্য একটু খাবারের খোঁজে রাস্তায় দিগ্বিদিক ছুটছেন। বাজারগুলো ফাঁকা, দোকানগুলো বন্ধ। আল জাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মানুষ আক্ষরিক অর্থেই এখন খাবারের জন্য হাহাকার করছে।
গাজার প্রবেশপথ বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সৌদি আরব কড়া বার্তা দিয়েছে ইসরাইলকে। তারা এই পদক্ষেপকে ‘ব্ল্যাকমেইল ও সম্মিলিত শাস্তির কৌশল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। তারা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছে, ইসরাইলের এই অমানবিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে।
এদিকে মিশর ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ না করেই গাজা পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করেছে। মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাতি জানিয়েছেন, গাজার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং তহবিল চাওয়া হবে। বিশেষ করে ইউরোপের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। আসন্ন আরব শীর্ষ সম্মেলনে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে, যেখানে গাজার পুনর্গঠনে প্রধান দাতা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় পুনর্গঠনের আগে ইসরাইলকে থামানো প্রয়োজন। হামাসের সঙ্গে করা যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত মানতে ইসরাইল রাজি নয়। বরং তারা যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য নতুন শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, যেখানে আরও কিছু জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে সাময়িক শান্তির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু হামাস এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ তারা জানে, ইসরাইল এই সুযোগ নিয়ে আরও ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে।
এদিকে গাজায় আটকে পড়া সাধারণ মানুষ আর কোনো বিশ্বাস রাখতে পারছে না। তারা চায় স্থায়ী শান্তি, কিন্তু ইসরাইল বারবার রক্তপাতের পথ বেছে নিচ্ছে। গাজার এক প্রবীণ বাসিন্দা সুফিয়ান আবু গাসান বলছিলেন, “আমাদের আবারও বিতাড়িত করতে চায় ইসরাইল। কিন্তু এবার আমরা কোথাও যাব না। মরতে হলে এখানেই মরব। আমাদের জন্মভূমি আমরা ছেড়ে যাব না।”
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। খাদ্য, পানি, ওষুধের সরবরাহ বন্ধ থাকলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি আরও বড় মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইসরাইল কি আদৌ কারও কথা শুনবে? নাকি তারা আগের মতোই নিষ্ঠুর বাস্তবতা চাপিয়ে দিয়ে গাজার লাখো মানুষের জীবন নিয়ে নির্মম খেলায় মেতে উঠবে?