গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ ও হামলা অব্যাহত, খাদ্যের পর এবার বিদ্যুৎ ও পানি বন্ধ
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যেই ইসরায়েল একের পর এক নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিচ্ছে। পুরো গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এক সপ্তাহ আগেই খাদ্যসহ মানবিক সহায়তায় অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে পবিত্র রমজান মাসে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে গাজার বাসিন্দারা। অন্যদিকে, যুদ্ধবিরতি ও বন্দি মুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও হামাসের আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার খবর প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম। তবে এ বিষয়ে কোনও পক্ষই নিশ্চিত করে কিছু জানায়নি।
ইসরায়েলি চ্যানেল ১২-এর বরাতে গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, হামাসের হাতে আটক আমেরিকান নাগরিকত্বধারী ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলোচনাও কোনো ফল দেয়নি। যদিও এর কয়েক ঘণ্টা আগেই ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যাডাম বোহলার ও হামাস নেতা খলিল আল-হাইয়ার আলোচনায় অগ্রগতি হওয়ার কথা জানিয়েছিল।
তবে বন্দি মুক্তি আলোচনা ব্যর্থ হলেও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার জন্য কাতারে প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নেতানিয়াহুর সরকার কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। যদিও প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির মেয়াদ এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাড়াতে চায় ইসরায়েল, কারণ দ্বিতীয় ধাপের শর্ত অনুযায়ী তাদের গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু হামাস স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা পূর্বনির্ধারিত শর্তেই দ্বিতীয় ধাপে যেতে প্রস্তুত।
ইতোমধ্যেই মিসরে হামাসের একটি প্রতিনিধি দল দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার বিষয়ে বৈঠক করেছে। তাদের দাবি, সীমান্ত খুলে দেওয়া, খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া, কোনো শর্ত ছাড়াই গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। অন্যদিকে, মিসরের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা শেষে হামাস জানিয়েছে, তারা গাজার জন্য একটি স্বাধীন প্রশাসনিক কমিটি গঠনের বিষয়ে একমত হয়েছে। তবে ইসরায়েল এতে সাড়া দেবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই ইসরায়েল গাজায় নতুন করে বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ হামলায় পাঁচ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ৩৭ জন। যুদ্ধবিরতির মধ্যে ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিনই হামলা চালাচ্ছে, যা মানবিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের এই আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৪৬০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১১ হাজার ৮৯৭ জনেরও বেশি। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়াদের উদ্ধারের মতো কোনো সুযোগও নেই, কারণ বোমা বর্ষণে গাজার অবকাঠামো পুরোপুরি বিধ্বস্ত।
হামাসকে তাদের শর্ত মানতে বাধ্য করার পদ্ধতি হিসেবে ইসরায়েল এবার গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ইসরায়েলের জ্বালানি মন্ত্রী এলি কোহেন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের আদেশে স্বাক্ষর করেছি। আমাদের লক্ষ্য, সব বন্দিকে ফিরিয়ে আনা এবং গাজা থেকে হামাসের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে ফেলা।’’ তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে গাজার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সেখানে বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্টগুলো ইসরায়েলের বিদ্যুতে চলে, ফলে পানি সরবরাহও থমকে গেছে।
গাজাবাসীদের দুর্ভোগ সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি কিছুই নেই। রমজানের শুরুতে চরম মানবিক সংকটের মুখে পড়েছেন তারা। খান ইউনিসের এক বাসিন্দা সামাহ সাহলুল বলেন, ‘‘আমরা রান্নার জন্য বিদ্যুৎ পাচ্ছি না, চুলার জন্য কাঠ নেই। আমার সন্তানকে কীভাবে খাওয়াব, তাও জানি না। ডায়াপার পর্যন্ত কিনতে পারছি না। এটা কোনো জীবন না।’’
আরেক গাজাবাসী সাহলা শরাব বলেন, ‘‘আমাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, আমরা তাঁবুতে থাকছি। সীমান্ত খুলে দিন, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। মুসলিম বিশ্বের প্রতি আমাদের আর্তি, আমাদের রক্ষা করুন।’’
এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই কাতারে ইসরায়েল ও হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতার। তবে বাস্তবতা বলছে, ইসরায়েল যেভাবে একের পর এক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাতে গাজায় মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হতে চলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সত্ত্বেও ইসরায়েল তার আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববাসী তাকিয়ে আছে, আদৌ এই সংকটের সমাধান হবে, নাকি ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ আরও দীর্ঘায়িত হবে।