টানা তিন বছর ধরে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ইউক্রেন এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। এর মধ্যেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে তিনি ক্ষমতা ছাড়তেও প্রস্তুত। তবে তার একমাত্র শর্ত, ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল মধ্যস্থতাকারী নয়, বরং সত্যিকারের অংশীদার হিসেবে দেখতে চান।
রোববার কিয়েভে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি বলেন, “যদি এটি একেবারেই প্রয়োজন হয়, তাহলে আমি আমার পদ ছাড়তে প্রস্তুত। তবে সেটি হবে একমাত্র ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদের বিনিময়ে।” তার এই বক্তব্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
জেলেনস্কি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের মধ্যে এমন একটি চুক্তি হওয়া উচিত যা উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক ও গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে বলছেন না, বরং ইউক্রেনের প্রকৃত অংশীদার হতে আহ্বান জানাচ্ছেন। তার ভাষায়, “আমি চাই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সত্যিকারের সহযোগী হোক। আমরা কেবল তাদের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা চাই না, বরং নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব চাই।”
এদিকে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান বলেও জানিয়েছেন জেলেনস্কি। তার মতে, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে বৈঠকের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক আরও স্পষ্ট করা দরকার। “ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে আলোচনার আগে আমাদের নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে হবে,” বলেন তিনি।
জেলেনস্কির মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউক্রেন যে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেয়েছে, তা ঋণ নয়, বরং অনুদান। তিনি বলেন, “আমাদের দেওয়া মার্কিন সহায়তাকে ঋণ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। এটি একটি অনুদান, যা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রদান করা হয়েছে।” তার এই বক্তব্য ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক দাবির বিপরীত। কারণ, ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা পরিশোধ করতে হবে এবং এ নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলেনস্কিকে স্বৈরশাসক বলে অভিহিত করা হলেও, এতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি তিনি। বরং বিষয়টি হাস্যকরভাবে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “একজন স্বৈরশাসকই শুধু এই শব্দে বিরক্ত হবে। আমি বৈধভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এই ধরনের মন্তব্য আমাকে বিরক্ত করে না।”
জেলেনস্কি আরও বলেন, ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা সহায়তার বিনিময়ে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলছে। “আমরা একটি পারস্পরিকভাবে লাভজনক চুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এই বিষয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন,” জানান তিনি।
ইউক্রেনের চলমান সংকটের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির এই বক্তব্য নতুন মোড় এনেছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তার আলোচনার আগ্রহ এবং প্রয়োজন হলে ক্ষমতা ছাড়ার ইঙ্গিত পশ্চিমা বিশ্বে নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। তবে ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার বিনিময়ে জেলেনস্কির পদত্যাগের সম্ভাবনা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এরই মধ্যে ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি ইউক্রেনের ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত হতে পারে, আবার কেউ এটিকে দুর্বলতার প্রকাশ হিসেবে দেখছেন।
এমন পরিস্থিতিতে, ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, সেটি এখন বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধ এবং ন্যাটোতে যোগদানের প্রচেষ্টার মধ্যে জেলেনস্কির ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীরভাবে নজর রাখছে।