খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ বিকেল পর্যন্ত চলে, যেখানে অন্তত ৬০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালীন কুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাছুদও আহত হন এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ছাত্রদল ক্যাম্পাসে সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করলে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়, ফলে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়। মঙ্গলবার দুপুরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধ চাই’ স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করলে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে তাদের সঙ্গে ছাত্রদল কর্মীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধে। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। ক্যাম্পাসে রড, লাঠি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলার ঘটনা ঘটে, যা পরে আশপাশের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
সংঘর্ষের সময় বহিরাগতদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, কুয়েটের পকেট গেট দিয়ে বহিরাগত কিছু ব্যক্তি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে এবং ছাত্রদলের পক্ষে সংঘর্ষে অংশ নেয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্রদল কর্মীরা পিছু হটলেও, বহিরাগতরা পুনরায় হামলা চালায়। একপর্যায়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষের সময় ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পাথর, ইট ও কাঁচের বোতল ছোড়ার ফলে বহু শিক্ষার্থী রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আহতদের দ্রুত কুয়েট মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গুরুতর আহত অন্তত ১০ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতদের মধ্যে আছেন প্রীতম বিশ্বাস, শাফি, নাফিস ফুয়াদ, সৌরভ, তাওহিদুল, ইউসুফ খান সিয়াম, দেবজ্যোতি, মাহাদি হাসান, নিলয় ও মমতাহিন।
ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং সংঘর্ষ থামাতে বিকেল ৫টার দিকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্য কুয়েটে প্রবেশ করেন। কিন্তু উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ক্যাম্পাসে প্রবেশে বাধা দেয় এবং ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধ চাই’, ‘রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’ স্লোগান দিতে থাকে।
কুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী রাহাতুল ইসলাম বলেন, "আমরা দুপুর ১টায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে ভিসির কাছে যাচ্ছিলাম, তখন ছাত্রদল কর্মীরা আমাদের বাধা দেয় এবং হুমকি দেয়। পরে তারা বহিরাগতদের নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। সংঘর্ষের শুরুতে ছাত্রদল কর্মীরা বলেছিল, ‘বিকেল ৫টা পর্যন্ত পুলিশ আসবে না, তোদের রক্ষা করবে কে?’ এরপরই তারা হামলা শুরু করে।"
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ নাজমুল হাসান রাজিব বলেন, "পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। আমরা কুয়েটের ভিসিসহ সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি এবং স্থানীয়দের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। পরিস্থিতি যাতে আরও মারাত্মক রূপ না নেয়, সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা মহানগর ও জেলা শাখা কুয়েটে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের হামলার প্রতিবাদে রাত সাড়ে ৮টায় নগরীর শিববাড়ি মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র আবদুল হান্নান মাসউদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, "কুয়েটে ছাত্রদল নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের স্টাইলে যে নৃশংস হামলা চালিয়েছে, এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের রাজনৈতিক কবর রচনা করছে।"
অন্যদিকে, ছাত্রদলের দাবি, তাদের কর্মীদের ওপর প্রথমে হামলা চালানো হয়েছে। খুলনা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক ইশতিয়াক আহমেদ ইশতি বলেন, "ছাত্রশিবির ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছদ্মবেশে কিছু লোক আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা আত্মরক্ষার্থে প্রতিরোধ করেছি।"
তবে ছাত্রশিবিরের মহানগর সভাপতি আরাফাত হোসাইন মিলন এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "আমাদের কোনো সদস্য কুয়েটের ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদল ও বিএনপি নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাই এবং দোষীদের বিচার চাই।"
কুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ বলেন, "বর্তমানে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি শান্ত। তবে সংঘর্ষের আসল কারণ তদন্ত করে জানা যাবে।"
কুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাছুদ বলেন, "আমি সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলাম, তখন ধাক্কাধাক্কিতে আহত হই। পরে মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছি।"
খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবির হোসেন জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং ক্যাম্পাসে আরও কোনো অস্থিতিশীলতা যেন না হয়, সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কুয়েটে সংঘর্ষের জেরে ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন জরুরি বৈঠকে বসছে বলে জানা গেছে। তবে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকবে কি না, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি।