মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি কেবল একটি সাধারণ ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়— এটা এক দিক দিয়ে পশ্চিমা ন্যায়বিচার ও কূটনীতির মুখোশ উন্মোচনের এক অন্তঃসারশূন্য থিয়েটার। ইরানকে কেন্দ্র করে যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার একদিকে রয়েছে ইসরায়েলের নির্লজ্জ আগ্রাসন; আর অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার তথাকথিত “কূটনৈতিক সংলাপের” ভান, যা বাস্তবে একপাক্ষিক চাপ প্রয়োগ ও নাটকীয় নিরপেক্ষতার আড়ালে পক্ষপাতের প্রকাশ।
মুখোশধারী কূটনীতি ও নিরব অনুমোদন:
এই নাটকের সূচনা হয়েছে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচির সঙ্গে জেনেভায় একটি সম্ভাব্য আলোচনার প্রেক্ষাপটে। তার আগে থেকেই মার্কিন প্রশাসন নেপথ্যে চাল চালিয়ে রেখেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও একাধিকবার ফোনে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল— ইরানকে ঘিরে “হুমকি” মোকাবেলায় পশ্চিমা ঐক্য নিশ্চিত করা।
অর্থাৎ, একদিকে তারা সংলাপের কথা বলছে, অন্যদিকে সেই সংলাপের আগেই তেহরানের আকাশে উড়ে বেড়ায় ইসরায়েলি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র। এটাই যেন এখন কূটনীতির সংজ্ঞা— আলোচনার মুখোশ পরে আগ্রাসনের চুপচাপ অনুমোদন।
ইউরোপীয় ত্রিমুখী দ্বিচারিতা:
ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন— এই তথাকথিত ইউরোপীয় ত্রয়ী নিজেদের “শান্তির পক্ষ” বলে প্রচার করলেও বাস্তবে তারা সরাসরি ইসরায়েলি আগ্রাসনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তারা বলে, “চলো আলোচনায় বসি,” কিন্তু একইসঙ্গে দাবি তোলে, “ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।” অথচ হামলার সূত্রপাতকারী ইসরায়েলের নামটি উচ্চারণ করতেই যেন তারা লজ্জা পায়।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ স্বীকার করেছেন যে, তেহরানে ইসরায়েলের হামলার তথ্য আগেই বার্লিনের জানা ছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সরাসরি বলছেন, প্যারিস ইসরায়েলকে রক্ষায় প্রস্তুত। যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে “আঞ্চলিক প্রস্তুতি”র নামে যুদ্ধবিমান ও সামরিক সহযোগিতা পাঠাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। এগুলো কি শান্তির ভাষা, নাকি সুশৃঙ্খল আগ্রাসনের কূটনৈতিক অনুবাদ?
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ওয়াডেফুল ঘোষণা করেছেন, “আমরা এখনই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত।” কিন্তু আলোচনার এই আমন্ত্রণ আদতে চাপ সৃষ্টির কৌশল মাত্র। যেখানে হামলার দায়ই স্বীকার করা হয়নি, সেখানে সংলাপ কেবল একতরফা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কৌশল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারণামূলক কৌশল:
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাকচি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “ইরানের ওপর আগ্রাসন বন্ধ না হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়।” কিন্তু মার্কিন রাজনীতি যুক্তির নয়, প্রচারণার উপর নির্ভরশীল। জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড সিনেটে পরিষ্কার বলেছেন, “ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না, এবং ২০০৩ সালের পর তাদের কর্মসূচিও স্থগিত রয়েছে।” ডেমোক্র্যাট সিনেটর মার্ক ওয়ার্নারও বলেছেন, “বর্তমান গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক বোমার দিকে যাচ্ছে না।”
তথ্য যখন পরিষ্কার, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণাটি—“ইরান কয়েক সপ্তাহ দূরে পারমাণবিক বোমা তৈরির থেকে”—মূলত একটি রাজনৈতিক নাটক ছাড়া কিছুই নয়। এতে স্পষ্ট, আমেরিকান রাজনৈতিক ঐকমত্য এখন বাস্তব গোয়েন্দা তথ্য নয়, বরং ইসরায়েলি ভাষ্যকেই অনুসরণ করছে।
‘আক্রমণকারী’ কে?:
সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—যে ইরান বারবার আগ্রাসনের শিকার, তাকেই এখন বিশ্বমাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে আক্রমণকারী হিসেবে। আর যে ইসরায়েল নির্লজ্জভাবে ইরানে হামলা চালাচ্ছে, সে হয়ে উঠছে “আত্মরক্ষাকারী”! এই প্রচারণা ইউরোপীয় “ন্যায়বিচার” নামক এক সাজানো থিয়েটারের অন্তিম দৃশ্য। যেখানে “মানবাধিকার”, “গণতন্ত্র”, “সংলাপ”—সবই একটি লোভনীয় মঞ্চসজ্জা, যার আড়ালে চলছে প্রকৃত যুদ্ধের অনুমোদন।
তারা বলে আলোচনার কথা, কিন্তু ঠিক সেই সময়েই বোমা ফেলে। তারা বলে মানবাধিকারের কথা, কিন্তু হাসপাতালে বোমা পড়ে। তারা বলে শান্তির কথা, কিন্তু প্রতিরোধ দেখলে বলে—‘সন্ত্রাস’। এমন দ্বিচারিতা শুধু ইরানের বিরুদ্ধে নয়, গোটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতি এক অবজ্ঞাসূচক উপহাস।
সংকট কেবল যুদ্ধ নয়, নৈতিকতারও:
এই সংকট কেবল মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি নয়, এটি একটি বৃহৎ নৈতিক ও বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করছে। ইরান হয়তো একাকী, কিন্তু যুক্তি, বাস্তবতা ও নৈতিক অবস্থান তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব যে পথে হাঁটছে, তাতে তারা কেবল যুদ্ধ নয়, নিজেদের আন্তর্জাতিক অবস্থানকেও অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
ইরানকে ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতি একটি বাস্তব পরীক্ষা— যেখানে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব সত্য ও আইনের পক্ষে দাঁড়াবে, না কি অস্ত্র শিল্প ও রাজনৈতিক মিত্রতার মোহে কাঁপবে? যদি এই একচোখা নীতি বন্ধ না হয়, তাহলে “আলোচনা” শব্দটি পরিণত হবে কেবল মুখোশধারী সংলাপকারীদের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনিতে— যার অন্তরালে থাকবে শুধু আগুন, ধ্বংস আর দ্বিচারিতা।
© স্যাম সাদী | ২০ জুন ২০২৫| লেখক একজন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক